রংপুরের পীরগাছার মাষাণকুড়া নদী পুনঃখননে ব্যাপক অনিয়ম
রংপুর প্রতিনিধি
রংপুরের পীরগাছায় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাষাণকুড়া মরা নদীর প্রাণ ফেরাতে পুনঃখননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নদীটি খননে প্রায় ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দিলেও দায়সারা খননে তা কোনো কাজেই আসছে না। নামমাত্র খননে নদীর প্রশস্ততা যেমন কমছে তেমনি অপরিকল্পিতভাবে পুনঃখননের কারণে আসন্ন বর্ষায় আবার তা ভরাট হয়ে পড়বে। এতে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য। আর পকেট ভরছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে জানা গেছে, মাষাণকুড়া মরানদী পুনঃখনন কাজে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে চলছে লুকোচুরি। চারটি অংশে ভাগ করে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও এক অংশের কাজের তথ্য দিয়ে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। সেটিও দৃশ্যমান স্থানে না দিয়ে লোক চলাচলহীন জায়গায় দেওয়া হয়েছে। সাইন বোর্ডে এক অংশের তথ্য দিয়ে পুরো চার অংশের কাজ চলছে। এদিকে কাজের জন্য নামমাত্র টাকা বরাদ্দ হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা প্রচার করছেন।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক দিন থেকে মাষাণকুড়ায় এস্কাভেটর(ভেকু) দিয়ে নদী পুনঃখননের কাজ চলছে। এ বিষয়ে কারো কাছেই সঠিক কোন তথ্য পাচ্ছেন না তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেও প্রকল্প বিষয়ে কোন তথ্য পাননি।
তবে তাদের অভিযোগ দায়সারা ভাবে খনন কাজ চলছে। নদীর তলদেশ যৎসামান্য খুঁড়ে পাড়ের মাটি কেটে প্রস্থ বাড়ানো হচ্ছে। সেই মাটি আবার ফেলে রাখা হচ্ছে নদীর পাড়েই। এতে তো কোনো লাভ হবে না, উল্টো ক্ষতি হবে। বর্ষা এলে পাড়ে রাখা মাটি ধসে আবার নদীতে পড়বে। তখন নদী আবারও ভরাট হবে, তাহলে দায়সারা ভাবে নদী পুনঃখনন করে তো কোন লাভ হবে না। শুধু শুধু সরকারের বিপুল পরিমান টাকা গচ্ছা যাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাষাণকুড়া মরা নদীটি পীরগাছা উপজেলার একমাত্র মৎস্য অভয়াশ্রম। এখানে প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে দেশীয় মাছ উৎপাদন হয়। জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের (২য় সংশোধিত) অধীনে ৬৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চারটি অংশে ভাগ করা হয়। প্রথম অংশে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় অংশে ১৯ লাখ ২০ হাজার, তৃতীয় অংশে ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা ও চতুর্থ অংশে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ৩১ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হলেও প্রকল্পের কাজ শেষের সম্ভাব্য তারিখ ৩১ মার্চ নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রতিটি অংশে ৩০ জন করে সুবিধাভোগী নিয়ে দল গঠন করা হয়েছে। যারা কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সম্পূর্ণ কাজটি করছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তার যোগসাজশে স্থানীয় একটি প্রভাবশালীমহল।
প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশটি মূল অভয়াশ্রম। এখানে পানির গভীরতা অনেক। এটি শুষ্ক মৌসুমেও শুকায় না। তাই এলাকাবাসীর কাছে এটি কুড়া নামে পরিচিত। এই অংশ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু এই অংশে নদীর তলদেশ খননের কোন সুযোগ নেই। এই অংশের বরাদ্দের টাকা পুরো লুটপাটের খাতায় যাবে বলে স্থানীয়রা জানায়। ইতিমধ্যে ওই প্রকল্পের চার লাখ ৬৯ হাজার টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, যেভাবে ভেকু দিয়ে দায়সারাভাবে নদী পুনঃখনন করা হচ্ছে তাতে বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও খরচ হবে না।
কাবিলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সবুজ মিয়া বলেন, শুরু থেকেই নদী পুনঃখননের বিষয়ে লুকোচুরি চলছে। সঠিক বরাদ্দের বিষয়ে কেউ মুখ খোলেনি। কিভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে তাও কেউ জানে না। শ্রমিকের বদলে ভেকু দিয়ে নদী খনন করা হচ্ছে। কোন সুবিধাভোগী নারী বা পুরুষকে নদী খননের সময় দেখা যায়নি। শুধু ভেকু চালকরা নিজ ইচ্ছেমতো কাজটি করছেন।
অনিয়মের মাধ্যমে কাজ চলছে স্বীকার করে স্থানীয় মৎস্যজীবী সমিতি ও প্রকল্পের চতুর্থ অংশের সভাপতি প্রেমা চন্দ্র বলেন, আমরা কাগজে কলমে থাকলেও আসলে কাজটি করছে অন্যরা। আমরা গরীব মানুষ এ রকম বড় প্রকল্পের কাজ করার সুযোগ কি আমাদের হয়।
সাইন বোর্ডের তথ্য অনুয়াযী উপজেলা মৎস্য দপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাকিবুর রহমান এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, প্রকল্পের ব্যাপারে আমার তেমন ধারণা নেই। সব জেলা অফিস থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যদিও আমি বেশ কয়েকবার প্রকল্প এলাকা পরির্দশন করেছি। তবে এভাবে খনন করায় বর্ষায় পাড়ের মাটি ধুয়ে আবার নদী ভরাট হবে বলে তিনি স্বীকার করেন।
রংপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বরুণ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সুবিধাভোগীরা নিজে কাজ না করে অন্যদের সহযোগিতায় ভেকু দিয়ে কাজ করছে লাভের জন্য। এতে লাভ হতেই পারে। প্রতিটি প্রকল্প লাভের জন্য করা হয়। আমার দরকার কাজ ঠিক ভাবে হচ্ছে কি না, সেটা দেখা। তবে প্রকল্প এলাকায় একটি অংশের কাজের সাইনবোর্ড আমিও দেখেছি। দ্রুত পুরো প্রকল্পের সাইনবোর্ড দৃশ্যমান স্থানে লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হবে। কাজ শেষে পুরো প্রকল্প মূল্যায়ন করে দেখা হবে।