ইভিএমে প্রথম ভোট, সাড়া দিচ্ছে সৈয়দপুর পৌরবাসী
ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়,নীলফামারী॥ এই প্রথম নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভা বাসিন্দারা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্বতিতে ভোট দিচ্ছেন। ইভিএমে ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া ভিন্ন ধর্র্মীর হলেও ভোটার উপস্থিতি কমতি নেই।
দেশের অষ্টম ব্যবসা বানিজ্য ও রেলের শহর এবং অবাঙালী (উর্দুভাষী) অধ্যুষিত বলে পরিচিত উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর পৌরসভা । শীতের বিদায় ঘন্টায় দেখা মিলছে সূর্য্যরে। ফাগুনের হাওয়া আর প্রকৃতির সুন্দর আমেজের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শুরু হওয়া ভোট প্রদানে ভোটকেন্দ্রে নারী ও পুরুষ ভোটার আসছে সমান তালে।
আজ রবিবার (২৮ ফেব্রুয়ারী/২০২১) পঞ্চম ধাপে সৈয়দপুর পৌরসভার আগামী ৫ বছরের জন্য মেয়র,ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নির্বাচনের ভোটগ্রহন চলছে। সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। চলবে বিরতীহীনভাবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। সকাল থেকেই ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভালো সাড়া দিচ্ছে সৈয়দপুর পৌরসভার ভোটাররা।
দুপুর ১২ পর্যন্ত সরেজমিনে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিত ছিল দেখার মতো। আরও দেখা যায়, প্রতিটি কেন্দ্রে নারী-পুরুষ ভোটাররা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে একে একে ভোট কক্ষে প্রবেশ করে সুন্দরভাবে ইভিএমে ভোট দিচ্ছেন। এছাড়া নিরাপত্তা ক্ষেত্রে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), পুলিশ, আনসার সদস্যরা সব সময় তৎপর রয়েছেন। ভ্রাম্যমান আদালতের ১৫জন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের টিম সার্বক্ষনিক টহলে রয়েছে।
জেলা নির্বাচন অফিসার ও সৈয়দপুর পৌরসভার রিটানীং কর্মকর্তা ফজলুম করিম জানান, সৈয়দপুর পৌরসভা নির্বাচনে এবার প্রতিদ্বন্দি মেয়র প্রার্থী ৫জন। এরা হলেন আওয়ামী লীগের রাফিকা আকতার জাহান (নৌকা), বিএনপির মো. রশিদুল হক সরকার (ধানের শীষ), জাতীয় পার্টির সিদ্দিকুল আলম (লাঙ্গল), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাফেজ মো. নূরুল হুদা (হাতপাখা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী রবিউল আউয়াল রবি (মোবাইল ফোন)। এ ছাড়া ১৫টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৮৭ জন এবং পাঁচটি সংরক্ষিত (নারী) ওয়ার্ড কাউন্সিলর ২১জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। তিনি আরও জানান,৪১টি ভোটকেন্দ্রে ৩৯৬টি ইভিএম মেশিনের মাধ্যমে ভোটাররা তাদের ভোট প্রদান করছে। ভোট চলাকালিন ইভিএম মেশিনে কোন ক্রুটি দেখা দিলে তা তাৎক্ষনিক মেরামত করার জন্য তৈরী আছেন ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলও। তারা ইসি কর্তৃক প্রেরিত। তিনি আরও বলেন, ভোট গ্রহনের জন্য ৪১টি কেন্দ্রে ৪১জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ২৬৪টি জন সহকারী প্রিজাইডিং এবং ৫২৮জন পোলিং কর্মকর্তা নিয়োজিত রয়েছেন।সৈয়দপুর পৌরসভায় মোট ভোটার ৯৩ হাজার ৮৯৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৪৬ হাজার ৭৬৩ জন এবং নারী ভোটার ৪৭ হাজার ১৩০ জন। অবাঙালী ভোটার রয়েছেন প্রায় ৪৫ হাজার। বিগত নির্বাচনগুলোতে দেখা দেখে উর্দুভাষী (বিহারী) ভোটাররা মূলত: যে প্রার্থীকে ভোট দেন নির্বাচনের জয়ের মালা তারই হয়।আর সে কারণে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা সবাই উর্দুভাষী (বিহারী) ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করেন। বিহারীদের (উর্দুভাষী) মোট ২২টি ক্যা¤প রয়েছে। আর তাদের বিদ্যমান সমস্যাসমূহ নিরসনে নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবারের মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দি প্রার্থীরা।
বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা ভোটারদের কথায় বোঝা গেল তারা ভোটিং সিষ্টেমে ব্যালটের চেয়ে ইভিএমকেই পছন্দ করলেন। ১ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব বোতলাগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বের হয়ে এসে উত্তরা আবাসনের অবাঙালী আব্দুস সাক্তার (৫০) নামের এক ভোটার বলেন, ইভিএমে এবারই প্রথম ভোট দিলাম। সকাল সকাল এসেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম।ভোট কেন্দ্রে কোনো ঝামেলা নেই। আমার ভোট আমি দিলাম এটা ভেবেই ভালো লাগছে। ব্যালট পেপারে কালির সিল মেরে ভোট দিতে হতো। আবার ব্যালট ভাজ করে বাক্সে ফেলতে হয়।যা ঝামেলা হতো। আর এখন এই প্রথম ইভিএমে ভোট দিয়ে বুঝলাম কত সহজ। এই মেশিনে যার ভোট সেই দিতে পারবে। এখানে জাল ভোট হবার কোন পথ নেই বলে এই ভোটার মনে করেন।
একই ওয়ার্ডের নারীদের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শতশত নারী ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের ভোট প্রদান করছেন। ৮৪ বছরের বৃদ্ধা অবাঙালী সালমা খাতুন বললেন “ হাম ইভিএম ডিজিটাল নেহি বুঝা। আপ ভোট দেয়া বুঝাগিয়াথা কই মালুন হ্যায়- ডিজিটাল ভোট দে দিয়া হাম।
জীবনে প্রথম ভোট তাও আবার ইভিএময়ে এমন আনন্দ খুশীর অনুভুতি ব্যক্ত করলেন এবার এইচএসসি পাস করা দুই ভোটার আসমা(২১) ও লাবনী(১৯)। তারা বললে জীবনের প্রথম ভোট দিতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করছি। খুব সহজভাবেই নিজের পছন্দমতো প্রার্থীদের ভোট দিতে পারলাম।
অন্যান্য ভোট কেন্দ্রের অসংখ্য ভোটারদের কাছে ব্যালট ভালো না ইভিএম প্রশ্ন করলে এক বাক্যে অনেকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন এখনতো দেখি ইভিএম এটায় ভালো, সহজ।
এদিকে নীলফামারী জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখছেন। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান জানান, ৪১টি ভোট কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহিৃত করা হয়েছে। এ জন্য তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরী করা হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে পাঁচ প্লাটুন বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের ১৯টি মোবাইল টিম, কেন্দ্রের বাহিরে চারটি স্টাইকিং ফোর্স এবং ১৫জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত দায়িত্ব পালন করছে।
জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট সকলকে পেশাদারিত্বের সাথে স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন ভাবে দায়িত্বপালনের জন্য দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ঠিক সেভাবেই এখন পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলছে। আশা করছি সৈয়দপুর পৌরসভার ভোট শান্তিপূর্ণভাবে আমরা সম্পন্ন করে ভোটের ফলাফল ঘোষনা করতে পারবো।
উল্লেখ যে, সৈয়দপুর বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলার একটি উপজেলা ও পৌর শহর। প্রশাসনিকভাবে এটি বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের তৃতীয় বৃহত্তম ও দেশের অষ্টম বৃহত্তম ব্যবসা বানিজ্য শহর। রংপুর বিভাগের একমাত্র বিমানবন্দরটি এখানে অবস্থিত হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ যোগযোগ কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এন-৫, যা এশিয়ান মহাসড়কের অংশ এ শহরের মধ্য দিয়ে গেছে। রয়েছে একটি সেনানিবাস ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কারখানা ও দেশের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল অবস্থিত।
সৈয়দপুর নামের উৎপত্তি স¤পর্কে জানা যায় যে, ভারতের কোচ বিহারের একটি সৈয়দ পরিবার এসে এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করে। সাধারণত এটি বিশ্বাস করা হয় যে, এই সৈয়দ পরিবারের নামে এই সৈয়দপুর নামটি নামকরণ করা হয়েছিল। অতীত ইতিহাসে এটি কামরূপ রাজ্যের অধীন ছিল। আলাউদ্দিন সৈয়দ হোসেন শাহ কামরূপ অভিযানের সময় সৈয়দপুরের নিকটে কেল্লাবাড়ীর হাটে একটি দুর্গ নির্মাণ করে সেখান থেকে কামরূপ অভিযান পরিচালনা করেছিল। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ঘিরেই সৈয়দপুর শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় অনেক বিহারী শরণার্থী ভারত থেকে সৈয়দপুরে চলে আসে। ১৯১৫ সালে রেলওয়ে স্টেশনের পাশে সৈয়দপুর থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে সৈয়দপুর পৌরসভা গঠিত হয়। যা ১৫টি ওয়ার্ড এবং ৪৩টি মহল্লা বিভক্ত। পৌরসভাটির আয়তন ৩৪ দশমিক ৩৪ বর্গকিলোমিটার। পৌরসভার সর্বশেষ মেয়র ছিলেন বিএনপির আমজাদ হোসেন সরকার। তিনি চলতি বছরের গত ১৪ জানুয়ারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। এবার তার ছোট ভাই বিএনপির হয়ে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া জন্মলগ্ন থেকে এই পৌরসভায় মেয়র পদে কোন নারী প্রার্থী বা মেয়র ছিলেন না। নৌকা প্রতিকে এবারই প্রথম এক নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন।সাধারন ভোটারদের মতে মেয়র পদে ৫ জন প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী থাকলেও এখানে ত্রি-মুখী লড়াই হবে নৌকা,ধানের শীষ ও লাঙ্গল প্রতিক প্রার্থীর মধ্যেই।#