নীলফামারীতে আটক ছাগল চুরির অপবাদে ইউপি চেয়ারম্যানের তালাবন্ধ ঘরে কিশোরের আত্মহনন
ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়,নীলফামারী॥ নীলফামারীতে ছাগল চুরির অপবাদ। অতপর পরনের শার্ট দিয়ে সিলিং ফ্যানে ফাঁস টানিয়ে আত্মহনন ঘটালেন বিপ্লব ইসলাম (১৭) নামে এক কিশোর। গতকাল সোমবার(৯ নভেম্বর/২০২০) সন্ধ্যা ৭টায় জেলা সদরের টুপামারী ইউনিয়নের রামগঞ্জ হাটে ওই ইউপি চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ঘটনাটি ঘটে।
রাত ৯টায় জেলা পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করে লাশ উদ্ধার করে থানায় নেয়। আজ মঙ্গলবার(১০ নভেম্বর/২০২০) বিকালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সে জেলা সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নর চৌধুরীপাড়া গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে। এলাকাবাসী জানায়, লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের দুবাছড়ি গ্রামের নিতাই নন্দী রায়ের একটি ছাগল (খাসি) গতকাল সোমবার বিকাল তিনটার দিকে বাড়ির এলাকা থেকে হারিয়ে যায়। এরপর থেকে পরিবারের লোকজন আশপাশ এলাকায় খুঁজতে থাকে। পরে নিতাই নন্দী রায় রামগঞ্জ হাটে এসে মাংস ব্যবসায়ী সহিদুল ইসলামের হাতে ছাগলটি দেখতে পায়। ওই ব্যবসায়ী ৫ হাজার ৫শ টাকায় ছাগলটি কেনার কথা জানালে তার মাধ্যমে বিক্রেতা বিপ্লব ইসলামকে সনাক্ত করে এবং তাকে (বিপ্লব) স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর কাছে নিয়ে যায়। ইউপি সদস্য বিপ্লবকে ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় গ্রাম পুলিশ নরেন চন্দ্র রায়ের কাছে সোপর্দ করেন। গ্রামপুলিশ ওই হাটে অবস্থিত টুপামারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মছিরত আলী শাহ ফকিরের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের একটি কক্ষে তালাবন্ধ করে রেখে চলে যায়। সন্ধ্যায় এসে দেখতে পায় বিপ্লব পরণের শার্ট খুলে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাটি জানাজানি হলে রাতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(প্রশাসন) আবুল বাশার মোহম্মদ আতিকুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নীলফামারী সার্কেল) রুহুল আমিন ও সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহমুদ উন নবী এসে ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করে লাশ উদ্ধার করেন।
এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক হয়েছেন বিপ্লবের মা বিউটি বেগম (৫০)। উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না এখন তার কি হবে। তার স্বামী শহিদুল ইসলাম তাকে ছেড়ে অবস্থান করছেন আরেক স্ত্রীর কাছে।
বিপ্লবের দুলাভাই জাহিদ ইসলাম বলেন, বিপ্লবের একমাত্র বোনের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার পর সে (বিপ্লব) আমার শাশুরীরকে নিয়ে শহরের বাড়াইপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতো। জীবিকা নির্বাহের জন্য সেখানে একটি ভাঙরীর কারখানায় কাজ করতো । আমার শ্বশুর তার আরেক স্ত্রীকে নিয়ে দিনাজপুরে অবস্থান করে হোটেল কারিগরের কাজ করেন। সোমবার সন্ধ্যায় খবর পেয়ে রামগঞ্জ হাটে ইউপি চেয়ারম্যানের অফিসে গিয়ে তার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পাই। তিনি বলেন, আমার শ্যালক সহজ সরল এবং শান্ত স্বভাবের একজন মানুষ। চুরি করার মতো তার কোন বদনাম নেই। সমাজে সে মান সন্মান নিয়ে চলার চেষ্টা করতো। আত্মহত্যা করার মতো মানষিকতাও তার কখনো দেখি নাই। এরপরও আত্মহত্যা করে থাকলে ছাগল চুরির অপবাদের কারণেই করতে পারে বলে আমার ধারণা। তবে ছাগল চুরির অপবাদ দিয়ে যারা তাকে আটকিয়ে রাখলো তারা কেন তাৎক্ষণিক পুলিশে দিল না? এমন প্রশ্ন তুলেন তিনি।
জাহিদুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, চুরির অপবাদে আটক করার পর তারা আমার শ্যালককে পুলিশে দিতে পারতেন। অথবা তাৎক্ষনিক সেখানে একটি বিচার শালিস করতে পারতো। তা না করে কেন তারা তাকে একা একটি ঘরে আটকিয়ে রাখলেন। এখন আত্মহত্যা করলেও এ দায় তাদেরকেই নিতে হবে। আমার শ্বশুর চট্টগ্রামে ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এলে মামলার বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হবে।
ছাগল মালিক নিতাই নন্দী রায় বলেন, আমি রামগঞ্জ বাজারে একটি দোকানের কর্মচারীর কাজ করি। বাড়ি থেকে খবর পেয়ে হাটের ছাগল বেচা-কেনার স্থানের দিকে এগুতে থাকি। পথে মাংস ব্যবসায়ী সহিদুলকে ছাগলটি নিয়ে যেতে দেখি। এবিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলে কেনার কথা জানায় এবং বিক্রেতা হিসেবে বিপ্লবকে সনাক্ত করে দেয়। পরে বিষয়টি আমি ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীকে অবগত করি।
এবিষয়ে ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী বলেন, গতকাল সোমবার বিকালে খবর পেয়ে ছাগলের মালিক নিতাই, ছাগল ব্যবসায়ী সহিদুল ইসলাম ও বিপ্লব ইসলামের অবস্থান স্থলে যাই। সেখানে ঘটনা শুনে বিপ্লবকে গ্রাম পুলিশ নরেন চন্দ্র রায়ের হাতে দিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান, হাটের ইজারাদার এবং বিপ্লবের অভিভাবককে খবর দিতে বলি। এরপর আছরের নামাজের পর গ্রাম পুলিশ নরেনকে আবারো ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলে সকলকে বলা হয়েছে বলে আমাকে জানায়। পরে ছেলেটির আত্মহত্যার খবর শুনতে পাই। তাকে তালাবন্ধ করে রাখার বিষয়টি জানা ছিল না বলে দাবি করেন তিনি।
গ্রাম পুলিশ নরেন চন্দ্র রায় বলেন, মেম্বার আমাকে যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন আমি সেভাবে কাজ করেছি। চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ছেলেটিকে তালাবন্ধ করে রেখে চাবি চেয়ারম্যানের ছেলের কাছে দিয়েছি। পরে জানতে পারি ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে।
তবে টুপামারী ইউপি চেয়ারম্যান মছিরত আলী শাহ ফকির বলেন, সোমবার বিকালে আমি কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় ছিলাম। সে সময়ে রামগঞ্জ হাটে আমার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে বিপ্লবকে আটকে রাখার বিষয়ে আমাকে কিছুই বলা হয়নি। সন্ধ্যায় বাড়ি এসে ওই ছেলেটির আত্মহত্যার বিষয়টি জানতে পারি।
এবিষয়ে সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহমুদ উন নবী বলেন, আমরা জিডির প্রেক্ষিতে লাশ উদ্ধার করে আজ মঙ্গলবার বিকালে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছি। পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নীলফামারী সার্কেল) রুহুল আমিন বলেন, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। #