ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহাসিক জিনের মসজিদের গল্প
https://www.obolokon24.com/2018/07/thakurgaon_22.html
ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে পঞ্চগড় এর বোদা উপজেলা যাওয়ার পথে ভূল্লী হাট । সেখান থেকেই প্রায় তিন কিলোমিটার পূর্বে বালিয়া “জিন মসজিদ” নামে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত।
মসজিদটি দেখতে দেখতে সামনে এসে হঠাৎ রমজান আলী নামের একজন বলে উঠলেন ভাই কাউকে খুঁজছেন। এরপরে তার মুখ থেকে শুনা গেলো সেই জ্বীনের মসজিদের নামের গল্পটি।
তিনি জানান, কোন এক আমবস্যার রাতে জ্বিন-পরীরা এই এলাকা উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এই বালিয়া ইউনিয়নের এলাকাটি পছন্দ করে। তারপর তারা মাটিতে নেমে এসে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করে, কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে যাওয়াতে কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যায় তারা। ফলে গম্বুজ ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকে অসাধারণ কারুকার্যময় মসজিদটি । জিন-পরীরা এটির কিছু অংশ তৈরি করেছে, এইজন্য স্থানীয়দের কাছে এটি জিনের মসজিদ নামে পরিচিত। এমনি একটি গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই মসজিদের নামে।
স্থানীয় বাসিন্দা ইবরাহিত আলী জানান, মসজিদটির প্রায় ১’শ ১০ বছরের মতো হবে। আমাদের এই এলাকাটি একটি উঁচু ও পিরামিড আকৃতির ছিলো। বন জঙ্গলের মধ্যেই ছোট্ট একটি মসজিদ ঘর নির্মাণ করে এলাকার মানুষ নামাজ আদায় করতো। এরপর মসজিদের কমিটির ও স্থানীয় সকলের সহযোগিতায় এই মসজিদের বাকী কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। প্রতিদিনেই কমবেশি অনেকেই আসে এই সুন্দর মসজিদটি দেখতে। মসজিদ দেখতে এবং সেখানে নামাজ আদায় করতে দুর-দুরান্তথেকে মুসল্লিরা আসতো। এখনো আসে শুধু এটি দেখার জন্য।
মসজিদটি নির্মাণের সময়:
মসজিদের গায়ে খোদাই করা সন অনুসারে মসজিদটি নির্মিত হয় ১৩১৭ বঙ্গাব্দে মানে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ । আবার মসজিদের নির্মাতা মেহের বকস চৌধুরীর কবরেও তার মৃত্যুর সন খোদাই করা আছে ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। মেহের বকসের মৃত্যুর সময়েই মসজিদটির বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে যায়।
মসজিদের নির্মাণের ইতিহাস:
জমিদার মেহের বকস চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দী শেষ ভাগে বালিয়াতে এক মসজিদ তৈরীর পরিকল্পনা করেন। এই জন্য দিল্লির আগ্রা মতান্তরে মুর্শিদাবাদ থেকে স্থপতি আনা হয়। মুঘল স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ডিজাইনকৃত এই মসজিদ তৈরির করাটা ছিল অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। হঠাৎ প্রধান স্থপতির মৃত্যুর ফলে মসজিদ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। মেহের বকস স্থানীয় কারিগরের সহায়তায় পুনরায় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কিন্তু স্থানীয় কারিগরগণ মসজিদের গম্বুজ নির্মাণে ব্যর্থ হন। ১৯১০ সালে মেহের বকস চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন।
মেহের বকসের ছোট ভাই কয়েক বছর পর মসজিদটি নির্মাণের জন্য আবারও উদ্যোগ নেন। কিন্তু, নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না করে তিনিও মৃত্যু বরণ করেন। ফলে মসজিদটি গম্বুজ ছাড়াই দাঁড়িয়ে থাকে।
অবশেষে মেহের বকস চৌধুরীর পৌত্র মরহুম বসরত আলী চৌধুরীর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ্ব তসরিফা খাতুন ৪ অগ্রাহায়ন ১৪১৭/১৯ নভেম্বর ২০১০ সালে ইনস্টিটিউটের কারিগরী সহায়তায় বালিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ শুরু করে। একই সাথে আর্কিটেক্ট সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল এর নকশাঢ নতুন ভাবে গম্বুজ নির্মাণ করা হয় ।
মসজিদটির আকার/আয়তন/বৈশিষ্ট্য
মসজিদটি সমতল ভূমি হতে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফ্রমের ওপর পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি ও উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি আয়তাকার কমপ্লেক্সে অবস্থিত । আয়তাকার কমম্পেক্সটি সিঁড়িসহ প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূলভবন বা নামাজঘর এই তিন অংশে বিভক্ত । এর মধ্যে মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্থ। প্লাটফর্ম হতে মসজিদটির ছাদ ১৭ ফুট উঁচু ।
মসজিদের ছাঁদে একই সাইজের তিনটি গম্বুজ ও আটটি মিনার আছে। যার মধ্যে চার কোণের চারটি মিনার বড় এবং বাকী চারটি ছোট। ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত। ইটে কোনো অলঙ্করণ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ইট কেটে কলস, ঘণ্টা, ডিশ,বাটি, আমলকি,পদ্ম ইত্যাদি নকশা তৈরি করা হয়েছে ।
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আখতারুজ্জামান জানান, ইতিমধ্যে আমি এই ঐতিহাসিক বালিয়া মসজিদে গিয়েছিলাম। আসলেই মসজিদটি দেখতে অনেক সুন্দর। বিশেষ করে সেখানার কার দেয়াল গুলোতে যে নকশা আঁকা আছে সেটি চমৎকার। আমার ঠাকুরগাঁও বার্ড ক্লাবের সাথে মিলে একটি ডুকুমেন্টারি তৈরী করছি যেখানে ঠাকুরগাঁও জেলার অনেক ঐতিহাসিক জিনিস আমার সকলের মাঝে তুলে ধরবো। সেটার মধ্যে আমার এই মসজিদটিও রেখেছি।
আসলে এই ডুকুমেন্টারি করার কারন হচ্ছে যাতে করে সকলে যানতে ও দেখতে পারে আমাদের এই জেলায় কতো রকমের সুন্দর সুন্দর ঐতিহাসিক জিনিস আছে।
তিনি আরো বলেন, মসজিদের ব্যাপারে মসজিদ কমিটির কোন রকমের কোন সহযোগিতার প্রয়োজন মনে করেন তাহলে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে অবশ্যই সেটি করা হবে।