সীমান্তের নারীদের আলোর পথ দেখাচ্ছে সংগ্রামী ফাতেমা
https://www.obolokon24.com/2018/04/thakurgaon.html
আব্দুল আউয়াল ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃসংগ্রামী ও আত্মপ্রত্যয়ী এক নারীর নাম ফাতেমা বেগম।অতিসাধারণ
হয়েও তিনি এখন অসাধারণ। যার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের সীমান্তবর্তী
এলাকার কমপক্ষে ২শ পরিবারের নারী সদস্যরা।
গ্রামে
স্কুল ছিলনা,বাড়ি হতে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরে একটি স্কুল
অবস্থিত।পাড়া-পড়শীর কেউ যেতোনা ওই স্কুলে। সঙ্গী সাথীর অভাবে ফাতেমারও
স্কুল যাওয়া হয়নি।তার গল্পটি গ্রাম বাংলার আর পাঁচটি নারীর মতোই।
ছোট
কাল থেকেই অভাবের মধ্যে বড় হয়েছে।পরিবারের তিনি বড়।তার দুই ভাইয়েরও
পড়াশোনার সুযোগ হয়নি।তের-চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর।স্বামীর সংসারেরও
অবস্থা ভালো ছিলোনা।বিয়ের দুই বছরের মাথায় পুত্র সন্তানের মা হন ফাতেমা।এর
পর আরেক পুত্র সন্তান তিনি জন্ম দেন।সংসারের সদস্য বেড়ে যাওয়ায় চার দিক
ঘিরে ধরে অভাব-অনটন।দম ফেলতে পারছিলোনা তাঁর স্বামী বাবুল হক।কুল কিনারা
খুঁজে পাচ্ছিলেননা।তাই চোরা পথে কাজের সন্ধানে ভারতে যান তার স্বামী।সেই
বছরটি ছিলো ১৯৯১।সেই দেশের পানিপথ ও পাঞ্জাব প্রদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকের
কাজ করেন বাবুল।আড়াই বছর পর পনের হাজার টাকা নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরেন।ঐ টাকা
দিয়ে শুরু করেন মুদির দোকান।কিছুদিন ভালোই চলছিলো তাদের সংসার।কিন্তু বাকি
বকেয়া পড়ায় ধীরে ধীরে পুঁজি হারিয়ে যায়। পুঁজি হারিয়ে চোখে সর্ষের ফুল
দেখে বাবুল।প্রানান্তর প্রচেষ্টা কঠোর পরিশ্রম আর সংগ্রাম করে দুর
করেছে নিজেদের বেকারত্ব,বয়ে এনেছে সফলতা,এনেছে সংসারে স্বছলতা।নিজে
স্বপ্ন দেখেছে,অন্যকেও ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে।আর এর সবটুকুই
সম্ভব হয়েছে দৃঢ় মনোবল ও ফাতেমার আত্মবিশ্বাসে।
তবে
পথ দেখিয়েছে স্থানীয় একটি এনজিও। আরডি আর এস-বাংলাদেশ নামে এই এনজিওটি
।সামান্য কিছু পুঁজি ও বাবুলের সঞ্চয়ী অভিজ্ঞতা এবং ঐ এনজিও টির ৫ হাজার
টাকা ঋণনিয়ে শুরু হয় ফাতেমার পথ চলা। চারটি মেশিন কিনে বাড়িতেই স্থাপন করেন
পাপোস(পামুছা) তৈরির কারখানা।দেশের অনেক লোক শিল্প যখন হারাতে বসেছে,তখন
মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে ঠাকুরগাঁয়ের ফাতেমার এই শিল্প।আর এটা বাস্তব
করেছেন সাহসী এই নারী উদ্যোক্তা।নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অনন্য ভূমিকা
রাখায় জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি।২০০৪ সালে শুরু করা ক্ষুদ্র এই
শিল্পটি কালের পরিক্রমায় বর্তমানে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে।ফাতেমার এখন দুটি
কারখানা।চারটি মেশিন থেকে সাতচল্লিশটি মেশিন তাঁর।খুব অল্প সময়ে তার
উৎপাদিত পাপসের কদর বাড়ে ।দেশ ও দেশের বাইরে বিক্রি হচ্ছে তার বানানো
পাপোস।
বাহারি নকশা ও
টেকসই হওয়ায় দিনদিন চাহিদা বাড়ছে। পুঁজি স্পল্পতার কারণে মেশিন বাড়াতে
পারছেনা ফাতেমা।ফলে চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হচ্ছেন।
এক
সময় তিনি নিজেই এই কাজ করতেন।এখন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন শ্রমিকদের আর কারখানা
তদারকি করছেন। তার স্বামী কাঁচামাল সংগ্রহ ও বাজারজাতের কাজ করছেন।তাঁর
কারখানায় শ্রমিকের কাজ করছে এলাকার দুইশত নারীও পুরুষ।তার মধ্যে স্কুল
কলেজ পড়ুয়া
শিক্ষাথীরাও রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের
অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিদিন তৈরি হয় কমপক্ষে তিন হাজার পাপোস।আর এই পাপস
বিক্রির টাকায় চলে ওই সব খেটে খাওয়া শ্রমিকের সংসার। চলে অনেকের পড়াশোনার
খরচ।দৈনিক আয় করেন তারা ২থেকে ৩শত টাকা।
জেলা
শহর হতে প্রায় ৪২ কি.মি দুরে সীমান্ত শহর রানীশংকৈল উপজেলা।এ উপজেলার
কাশিপুর ইউনিয়নের পশ্চিম কাদিহাট জোতপাড়া গ্রামে ফাতেমার কারখানা।
ঠাকুরগাঁও জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস সহ দেশের গুনীজন
ফাতেমার কারখানা পরিদর্শন করে বিস্ময় প্রকাশ করেন।তিন বছর আগে কন্যা
সন্তানের মা হন তিনি।তার নাম রেখেছেন বুশরা।আরবী ভাষার অর্থ খুশির সংবাদ।
জীবন
যুদ্ধ ও দীর্ঘ সংগ্রামে পরিবারটি এখন খুশির ভূবনে ভাসছে।ফাতেমার সাফল্য
দেখে এলাকার অনেক নারীই এখন স্বপ্ন দেখছেন স্বাবলম্বী হওয়ার।