রংপুরে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক ব্যবসা
https://www.obolokon24.com/2017/05/rangpur_93.html
হাজী মারুফ :
রংপুরে অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই এবং প্রয়োগ করার উপায়ও নেই। ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্যসেবা চলছে গঠিত সিন্ডিকেটের খেয়াল খুশিতে। যাদের কাছে জিম্মি সিভিল সার্জনসহ রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাগণ।
রাস্তার এপারে ওপারে অলিতে গলিতে গজিয়ে উঠেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই অসংখ্য ক্লিনিক। ধাপ, রামপুরা, খলিফাটারী, মেডিকেল পূর্বগেট, পাকারমাথা, হাজিপাড়া, লালকুঠি, সাগর পাড়া, কেরানীপাড়াসহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুরদিকে ও নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩ কিঃ মিঃ এলাকার বাড়ি ওয়ালা মালিকরা এখন আর তাদের বাড়ি আবাসিক কাজে ভাড়া দেয় না। কারণ নামমাত্র ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টার খুলে ডাঃ কন্ট্রাক্ট করলেই হলো। যে কারণে ব্যাঙ্গের ছাতার মত ক্লিনিক বেড়েই চলেছে। এসব ক্লিনিকের ঘর বাথরুম বিছানাপত্রের অবস্থা দেখলে মনে হয় এখানে রোগির একটা অসুখ ভালো হলেও অসংখ্য অসুখ সৃষ্টির সম্ভাবনা বিদ্যমান। নিম্মমানের বেড ননডিপ্লোমাধারী নার্স যাদের বেতন ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
চলমান বার্তার বিশেষ প্রতিনিধি দীর্ঘদিন ধরে সরেজমিন ঘুরে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সর্বপরি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবীণ ও প্রবীণ কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে তৈরী করেছেন এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। যার ১ম পর্ব প্রকাশ করা হলো আজ। রংপুরে ডাক্তার এবং সার্জনরা বাংলাদেশের যে কোন জেলার চাইতে ব্যস্ত সময় পার করেন। এদের মধ্যে এমনও কিছু ডাক্তার আছেন যারা বিশ্রাম ছাড়াই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপারেশন করে চলছেন। সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিকরা স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। কারণ সিন্ডিকেটটি এতোটাই ক্ষমতাধারী যে খুলনার এরশাদ শিকদারের সঙ্গে কর্মের গভীর মিল রয়েছে। পার্থক্য এরশাদ শিকদারের জাড়ি জুড়ি ফাঁস হয়েছে, আর রংপুর সিন্ডিকেট চক্রের অসীম ক্ষমতাধরদের কু-কর্মের পর্দা এখনো ফাটেনি।
রংপুরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অভ্যান্তরে প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা বিস্তৃত। এরা সকলেই বহিরাগত দালাল নয়, এদের মধ্যে অনেকেই আছেন সম্প্রতি শুরু হওয়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া স্বল্প বেতনের কর্মচারী। যারা রোগির আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় ক্লিনিকে পাঠাতে উৎসাহিত করেন। শুধু তাই নয় এখানে ট্রাকের দালালী ও হাট-বাজারে গরুর দালালের মতো মৃত মানুষ বহনকারী গাড়ির দালালিও চলছে দিনে রাতে। একজন মানুষ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির অসহায় পরিবারকে দালালরা ঘিরে ধরে একজন দালাল ভাড়া কন্ট্রাক্ট করে, যার গাড়ি আছে তার হাতে তুলে দিয়ে নির্দিষ্ট হারে কমিশন নিয়ে চলে যাচ্ছে ভুক্তভোগি শোকাহত পরিবার। সেই হাড়ে বাড়ছে রোগির সংখ্যাও। তবে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত ছাড়পত্র, কিনিক্যাল বর্জ্য অপসারণ এবং প্রক্রিয়াজাত করণের বালাই নেই এইসব ক্লিনিকে।
ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, রংপুরে নিবন্ধনকৃত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রয়েছে ১৫৬ টি। এরমধ্যে ৭২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ৮৪টি ক্লিনিক। এখন এর সংখ্যা আরো বেড়েছে। সূত্র জানায়, এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিদিনের সৃষ্ট বর্জ্য অপসারণ ও প্রক্রিয়াজাতের ক্ষেত্রে বিধিমালা ২০০৮ এবং সংশোধিত পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ কোন প্রতিষ্ঠানে মানা হচ্ছে না। ফলে অপারেশনকৃত বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, গজ-ব্যান্ডেজ, ব্যবহৃত ওষুধ, সিরিঞ্জ-সুঁই, পরীক্ষা কাজে ব্যবহৃত স্লাইড, রোগিদের উচ্ছিষ্ট খাবার, এক্সরে রেডিয়েশনসহ অন্যান্য বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে না। যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলার নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে কথা হলে তারা জানান, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সৃষ্ট ক্ষতিকর বর্জ্য যথা সময়ে যথাযথভাবে যাতে অপসারণ করা হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ফলাফল লক্ষ্য করিনি। তবে পরিবেশ অধিপ্তর জানায়, লোকবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সৃষ্ট বর্জ্য যাতে অপসারণ ও প্রক্রিয়াজাত করার বিধিমালা ২০০৮ এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র আইন ২০১০ বাস্তবায়িত হয়, সেজন্য ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। পরিবেশ আদালতও তার যথাযথ কার্যক্রম শুরু করেছে। ফলে পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি আশাবাদি। এদিকে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের দাবি, পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া নিয়ম অনুযায়ি তারা বর্জ্য অপসারণ করছেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশনকে বর্জ্য অপসারণে নির্ধারিত চাদাঁও পরিশোধ করেন। তবে বেশির ভাগ বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে। জেলা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সামসুর রহমান বলেন, আমরা সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ভ্যানে বর্জ্য অপসারণ করি। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম মেনে এ বর্জ্য ধ্বংস করতে গেলে বিশেষ চুল্লি স্থাপন করা প্রয়োজন। যার নির্মাণ ব্যয় প্রায় দেড় কোটি টাকারও বেশি। ফলে প্রত্যেক মালিককে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হবে। যার ব্যয় বহন করা অনেক মালিকের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, আগে স্বপ্ন নামে একটি এনজিও বর্জ্য শোধনের নামে ক্লিনিক মালিকদের টাকা হাতিয়ে পালিয়ে গেছে। আমরাও চাই নিয়ম মেনে বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠুক। এজন্য সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মালিক জানিয়েছেন, এরআগে বগুড়া থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। ওই সময় একটি নোটিস জারি করা হয়েছিল। যার বাস্তবায়ন করান জন্য প্রত্যেক মালিক তখন ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু তারা কোন কাজ না করেই সমস্ত টাকা লোপাট করেছেন।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন জাকিরুর ইসলাম লেলিন জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হলে প্রথমে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। পরিবেশ অধিদপ্তর উদ্যোগি হয়ে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যার অবসান করতে পারে। পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারদের নিয়েও এ আলোচনা সভা হতে পারে। সবার স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণে এ কার্যক্রম সফল করতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আখতারুজ্জামান টুকু ৭৪টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। যারা আইন মানবে না, তাদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন রংপুরে পরিবেশ আদালত হয়েছে। লোকবল কম হলেও কাজের গতি বাড়ছে। তাছাড়া রংপুরসহ লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়ে পরিবেশ দূষণ রোধে কাজ করছি। সিটি মেয়র (প্রতিমন্ত্রী) শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু বলেন, কিনিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সিটির পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত কর্মীরা ওই বর্জ্য সংগ্রহ করে যথা সময়ে পুড়িয়ে দেন অথবা নির্দিষ্ট স্থানে মাটিতে পুঁতে ফেলে। কিন্তু সিরিঞ্জ ও সুঁই ধ্বংস করার মেশিন না থাকায় নিরাপদ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা যদি পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত কর্মীদের সার্বিক ব্যয় বহন করতে রাজি হন, তাহলে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব বলে মেয়র দাবি করেন।