৫৪ বছর পর তিস্তা তার পুরানো পথে
https://www.obolokon24.com/2016/07/tista_7.html
ইনজামাম-উল-হক নির্ণয়, নীলফামারী ১৬ জুলাই॥
৫৪ বছর পর তিস্তা নদী তার পুরানো পথেই আবার ফিরে গিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে শেষ রক্ষা আর হলো না ওই সব এলাকার জনবসতি,হাটবাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সব কিছু। এক দিকে নদীর ¯্রােত অন্য দিকে ভাঙ্গন। শনিবার দুপুরে তিস্তার প্রবল ভাঙ্গনে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের মধ্যচরখড়িবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চোখের সামনে নদীতে ভেঙ্গে বিধ্বস্থ হয়। শুধু এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নয় ওই ইউনিয়নের ৪ টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি উচ্চ বিদ্যালয়, ১টি নার্সারী স্কুল, ২টি কমিউনিটি ক্লিনিক, রাস্তাঘাট, ব্রীজ, কালভাট,শতশত হেক্টর আবাদী জমি ও সহ¯্রাধীন পরিবারের বসতভিটা বন্যা ও ভাঙ্গনের কবলে পরে বিলিন হয়ে গেছে। যে কোন সময় চরখড়িবাড়ি সীমান্তের বিজিবির দ্বিতল ভবনটিও বিলিন হয়ে যাওয়ার পথে। ফলে বিজিবির পক্ষে ওই ক্যাম্পের সকল জরুরী ও প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
তিস্তা নদীর কড়াল গ্রাসে শনিবার ভোরে নতুন করে চরখড়িবাড়ি এলাকায় আরো ২৭৯ টি বসতভিটা বিলিন হয়েছে। সেই সাথে বিলিন হয়েছে ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি উচ্চ ্িবদ্যালয়ের ৮১টি ফিট তিনটি ক্লাস রুম। এখন সম্পুন্ন স্কুলটি বিলিনের পথে। এর সাথে একতার বাজারটি ভাঙ্গনের মুখে পড়ায় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিচ্ছে। অপর দিকে চরখগিবাড়ি সীমান্তের বিজিপির ক্যম্পে তিস্তার নদীর বানের পানি প্রবেশ করেছে।
শনিবার সকাল ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নীলফামারী জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন,ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে সাথে নিয়ে টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন তিস্তার বন্যা ও ভাঙ্গন এলাকা পরিদর্শন করান।
এদিকে শনিবার ভোর থেকে উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার (৫২ দশমিক ৪০ মিটার) ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও ডিমলা উপজেলার ৭ ইউনিয়নের চর ও চর গ্রামগুলো বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোডের বন্যা পুর্বাভাস ও সর্তকীকরন কেন্দ্র বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান উজানে ভারী বৃস্টিপাত ও ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যে কোন সময় তিস্তা বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
এদিকে তিস্তার বন্যা ও ভাঙ্গন পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন জানান বিশেষ করে ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চরখাড়িবাড়ি সহ ১০টি গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারন করেছে।
এলাকার ঘরবাড়ি স্কুল,আবাদী জমি, হাটবাজার সব কিছু তিস্তা গ্রাস করে চলেছে। তিনি ওই সব এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমান ত্রানের ব্যবস্থা করার কথা জানান। সেই সাথে ওই এলাকায় একটি বাঁধ নির্মানের প্রয়োজনের কথা জানান জেলা প্রশাসক।
শনিবার ওই সব এলাকা ঘুরে দেখা যায় তিস্তা নদী ১০ গ্রামের উপর দিয়ে তিস্তা নদীর বানের পানি প্রবাহিত হয়ে চলেছে। প্রচন্ড ¯্রােত আর শোঁ শোঁ শব্দ তিস্তারপাড় কাঁপিয়ে তুলেছে। তিস্তা হিং¯্ররূপ এলাকাবাসীকে আতংঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছে। কি হবে কি হচ্ছে তা এলাকাবাসী ভেবে পাচ্ছেনা।
তিস্তার বানের পানি চরখড়িবাড়ি দ্বিতল ভবন বিজিবি ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা যায়।
এলাকার একতার বাজারটি তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের কবলে পড়ায় হাটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী আব্দুল হাই (৬৫) জানান এই জীবনে তিস্তার এমন রাক্ষুসী রূপ দেখিনি।
টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন জানান তিস্তা নদীর গতিপথ পাল্টে যাওয়ায় ১০টি গ্রাম এখন তিস্তা নদীতে পরিনত হয়েছে। নদী এখন এসব গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেই সাথে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে মধ্য চরখড়িবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, টাপুর চর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, টেপাখড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় ও ওই গ্রামের ত্রানের ৩৯ ফিট একটি ব্রীজ। এছাড়া বিএডিসির চরখড়িবাড়ী এলাকায় গত ২ বছর আগে নির্মিত ১৭ ফিট ১টি ব্রীজ, ঝিঞ্জির পাড়ায় এলজিইডির নির্মিত ৭০ ফিট ১টি ব্রীজ ও পূর্বখড়িবাড়ী এলাকায় এডিপির ১০ফিট একটি ব্রীজ বিলিন হয়েছে। এ ছাড়া ১০টি গ্রামের সহ¯্রাধীন পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে।
এলাকাবাসী জানায় গত কয়েক দিনের টানা বর্ষন ও উজানের ঢলে তিস্তার পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আবার হটাৎ পানি বিপদসীমার নিচে নেমে আসায় ভয়াবহ ভাঙ্গনের দেখা দেয়। ডিমলা উপজেলা প্রশাসন ও এলাকার মানুষজন স্বেচ্ছাশ্রমে ভাঙ্গন রোধে বালির বস্তা বাঁশ ও গাছের পাইলিং করেও ভাঙ্গনের কবল থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, রক্ষা করতে পারছে না। এ ছাড়া ওই এলাকার দুইটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবন বিলিন হয়ে যাচ্ছে বলে সিভিল সার্জন ডাঃ আব্দুর রশিদ জানান।
পানি উন্নয়ন বোড সুত্র মতে ১৯৬২ সালে তিস্তা নদী চরখড়িবাড়ি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। এরপর সেটি পাল্টে তিস্তা ভারতের মেখলিগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশের কালিগঞ্জ জিরো পয়েন্ট দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছিল বাংলাদেশে। দীর্ঘ ৫৪ বছর তিস্তা পুনরায় তার পুরানো পথে ফিরে প্রবাহিত হচ্ছে।
ফলে ৫৪ বছর ধরে ওই সব এলাকায় গড়ে উঠা জনবসতি হাটবাজার বসতভিটা,আবাদী জমি,স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক সব এখন নদীর বুকে।
এলাকাবাসী জানায় ৫৪ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারের সব কিছু আজ তিস্তার পেটে চলে যাচ্ছে। গলা ভরা ধান পুকুর ভরা মাছ,গোয়াল ভরা গরু সব শেষ করে দিল তিস্তা। এলাকার মানুষজন যে যেখানে পারছে মাথাগোজার ঠাই করে নিচ্ছে। মাথা গোজার ঠাই পেলেও তিস্তানদীর বন্যা ও ভাঙ্গনে ওই সব এলাকায় মানুষজনের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে বলে জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছে।